সমস্ত লেখাগুলি

ভারতীয় মানসে শ্রেণীচেতনার অভাব -
মনীশ রায়চৌধুরী
May 20, 2025 | রাজনীতি | views:3 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বর্তমান ভারতের অধঃপতনের অন্যতম কারণ শ্রেণী চেতনার অভাব। এই দৈন্যতার ফলেই মানুষ তার শত্রু-মিত্র চিনতে বারবার ভুল করছে। ভোটের  সময়ও তারা জাতি, ধর্ম, বর্ণের ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচিত করছে। ফল ভুগছে, কিন্তু ঐ যে বললাম শ্রেণী চেতনার অভাব, ফলে সেই ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। 


মানুষের শ্রেণী চেতনার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তার শিক্ষা-সংস্কৃতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবশ্যই বিচার্য। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষ গড়ার একমাত্র মাপকাঠি নয় ঠিকই, কিন্তু অন্যতম জরুরি একটা মাপকাঠি। অন্তত, একটা স্তর পর্যন্ত প্রথাগত শিক্ষা না থাকলে কোনও মানুষ নিপীড়িত, বঞ্চিতদের জন্য যতই সৎভাবে আন্দোলনের চেষ্টা করুক একটা সময়ে বাধাপ্রাপ্ত হবেই। আধুনিক শিক্ষার অভাবে তার পক্ষে বিশ্বে পূর্বে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের সফলতা বা ব্যর্থতার উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া সম্ভব হবে না। প্রয়োজন অনুসারে নতুন রণকৌশল অবলম্বন করার ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা দেখা যাবে। আধুনিক শিক্ষার অভাবে সংগ্রামী জনতাকে ভুল বুঝিয়ে বিপথগামী করা গেছে, তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে এমন উদাহরণও বিরল নয়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সাঁওতাল বিদ্রোহ, কোল, ভিল, মুন্ডা বা চুয়াড় বিদ্রোহ সেই সময়ে প্রবল আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু ইংরেজরা সেই বিদ্রোহ দমন করতে সফল হয় কারণ বিদ্রোহী জনতার কাছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অভাব ছিল।


ভারত বহু ভাষা, ধর্ম, জাতির দেশ। তাই ইউরোপীয় দেশগুলোর মত এখানকার মানুষের শ্রেণীচরিত্র বোঝা অত সহজ নয়। লোকসভা বা বিধানসভা প্রতিটি নির্বাচনেই প্রার্থীর ভাষা, জাতি, ধর্ম বড় ভূমিকা পালন করে।


মহারাষ্ট্রকে ভারতের প্রাণকেন্দ্র বলা চলে। স্বাধীনতার পরে দীর্ঘকাল এখানে কংগ্রেসের শাসন ছিল। তারপর মারাঠি অস্মিতার উপর ভর করে বালাসাহেব ঠাকরের উত্থান শুরু হল। ‘মারাঠি মানুষ’ আবেগ তৈরি করা হল। নিজের ভাষা, সংস্কৃতির উপর গর্ব অবশ্যই ভালো। কিন্তু যখনই তা অন্যদের প্রতি বিদ্বেষের সৃষ্টি করে তখনই ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। বালাসাহেবও সুকৌশলে মারাঠি আবেগের নামে বিদ্বেষের রাজনীতি শুরু করলেন। মহারাষ্ট্র থেকে মারাঠি বাদে অন্যদের, বিশেষত বিহারিদের মেরে তাড়ানো শুরু হল। ১৯৮৯ সালে তার দল শিবসেনা বিজেপির সাথে জোট গঠন করে। মারাঠা মানেই শিবাজি, শিবাজি মানেই ঔরঙ্গজেবের সাথে দ্বন্দ, মানে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ, অর্থাৎ হিন্দুরাজত্বের সূচনা। এমন সহজ সমীকরণই দুটো দলকে কাছাকাছি এনেছিল। ১৯৯৫ তে শিবসেনা প্রথমবার মহারাষ্ট্রতে ক্ষমতা দখল করে। দেখতে দেখতে মহারাষ্ট্রতে জাতীয় বীরের মর্যাদা পেতে শুরু করেন। তার ইচ্ছাই মারাঠিদের কাছে ঈশ্বরের বিধান হতে শুরু করল। শিবসেনা বা বালাসাহেবের বিরুদ্ধে ওঠা প্রতিটা প্রতিবাদী কন্ঠকে মারাঠি ভাবমূর্তিতে আঘাতের অজুহাতে স্তব্ধ করে দেওয়া হতে থাকল। ২০১৬ সালে শিবসেনার ঘোষিত সম্পত্তিই ছিল ৩৯৫.৬৮ মিলিয়ন টাকা। এই বিপুল সম্পদ যে সৎপথে অর্জিত হয়নি সেটা বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হতে হয়না। কিন্তু, মারাঠি জনতার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কতটুকু উন্নতি হয়েছে? শাহরুখ, শচীন, অমিতাভের বিলাসবহুল বাড়ি বা জুহুবিচ কি মেরিন ড্রাইভই তো মহারাষ্ট্র নয়। অগণিত মারাঠি মানুষ বস্তিতে গাদাগাদি করে জন্মাচ্ছে, বড় হচ্ছে, মারা যাচ্ছে তাদের কতটুকু উন্নতি ঘটল? কিন্তু, মানুষ এইসব প্রশ্ন তুলতেই ভুলে গেছে কারণ শিবসেনা তাদের কাছে মারাঠি আবেগের প্রতীক। বছরের পরে বছর তারা সেই আবেগের ললিপপ চুষে চলেছে। 


বিহার এবং গোবলয়ের রাজ্যগুলিতে ভোট হলেও সেই জাতপাত সামনে চলে আসে।

যাদব শুধু যাদব প্রার্থীকেই ভোট দেয়। ব্রাহ্মণ ভোট ঠাকুররা পাবে। দলিত ভোট দলিত বা ‘পিছড়া বর্গের’ লোক পায়। এবারে উত্তরপ্রদেশের ভোটে জিতে বিজেপির যোগী আদিত্যনাথ পুনরায় সরকার গঠন করেছে। প্রায় কোনরকম জনকল্যাণমুখী কাজ না করেও যে ক্ষমতায় ফেরা যায় উত্তরপ্রদেশ তার নজির হয়ে থাকল। এই জয়ের অন্যতম কারণ ভোট কাটাকাটি। ব্রাহ্মণ তথা উচ্চবর্গের দরিদ্র মানুষ আরও বেশি দরিদ্র হয়েছে, অনেকেই কাজ হারিয়েছে। তাদের অনেকেই বুঝতে পারছে এই কুশাসনে তাদের কোন উন্নতি নেই। তবু তারা বিজেপকেই ভোট দেবে। কারণ তাদের বোঝানো হয়েছে বিজেপি হিন্দু ধর্মের রক্ষক এবং তারা না থাকলে মুসলমানরা সব দখল করে নেবে। অর্থাৎ প্রার্থীর যোগ্যতার তুলনায় তার ধর্ম পরিচয় অগ্রাধিকার পেয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনেক ঠাকুর, ব্রাহ্মণদের বলতে শোনা গেছে মুসলমানদের পার্টি হল কংগ্রেস, যাদবদের দল সমাজবাদী পার্টি, দলিতদের দল বিএসপি, মানছি যোগী সরকার ততটা উন্নতি করেনি কিন্তু আমাদের দেখার আর কোন দল নেই। 


কিন্তু এই ধর্মীয় জাতপাতের গোঁড়ামি শুধু আছে ভাবলে ভুল হবে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় নিজেরাও কিন্তু নিজেদের মানুষ ভাবার পরিবর্তে সংখ্যালঘু প্রমাণ করতেই সচেষ্ট থেকেছে। অত্যন্ত লজ্জাজনক হলেও এটাই সত্য যে এখনও মুসলিম প্রধান অঞ্চলে রাজনৈতিক দলগুলিকে ভোট পাওয়ার জন্য মুসলিম প্রার্থী দিতে হয়। এখানেও প্রার্থীর যোগ্যতার তুলনায় ধর্মীয় পরিচয় অগ্রাধিকার পেয়ে যায়। ধর্মীয় গোঁড়ামির উর্ধ্বে ওঠার পরিবর্তে ইমাম ভাতা, হজ যাত্রার ব্যবস্থা কোন দল করে দেবে তাতেই তারা বেশি আগ্রহী। তাদের অধিকাংশ ইমাম এবং ধর্মগুরুরাও বুঝে গেছে এই ভেড়ার পালকে ধর্মের আফিমে বুঁদ করে রাখতে পারলেই তাদের ইচ্ছেমতো কাজে লাগিয়ে নিজেদের মৌরসীপাট্টা কায়েম রাখা যাবে।


দলিত, SC, ST, OBC প্রভৃতি তথাকথিত নিচু জাতের মানুষও কিন্তু এই মূর্খতা করে চলেছে। ১৯৬৪ সালে দলিত নেতা মান্যবর কাঁসিরামজী পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তার এই লড়াইকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। ১৯৮৪ সালে তিনি রাজনৈতিক দল গঠন করেন তার নাম ‘বহুজন সমাজ পার্টি’। এরপর মায়াবতীর হাত ধরে দল দ্রুত ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকে। উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতায় আসীন হয় বিএসপি, মুখ্যমন্ত্রী হলেন মায়াবতী। স্বাভাবিক ভাবেই দলিতরা তাদের আদরের ‘বেহেনজি’র মধ্যে মুক্তিদাতার ছবি দেখেছিলেন।

কিন্তু মায়াবতী গদিতে বসে চূড়ান্ত বিলাসবহুল জীবনযাপন শুরু করলেন। জনতার উন্নয়নের অর্থ দিয়ে সারা উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী, কাঁসিরাম এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতীক হাতির স্ট্যাচু নির্মিত হল। মায়াবতী সরকারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের একটি PIL থেকে জানা যায় ৫২.২০ কোটি টাকা ব্যয় করে বিভিন্ন পার্কে প্রায় ৬০ টি হাতির স্ট্যাচু তৈরি করা হয়। ২০০৮-০৯ এবং ২০০৯-১০ বাজেট বরাদ্দের ২০০০ কোটি টাকার প্রায় ৯০% তিনি ব্যক্তিগত এবং দলীয় প্রচারে অপচয় করেছিলেন। 

অথচ, এতকিছুর পরও দলিতদের কাছে তাদের ‘বেহেনজি’ একজন মসিহা। তারা বিএসপিকেই ভোট দেবে। দলিতদের সঠিক শ্রেণীচেতনা নেই বলেই তারা বুঝতে পারছেনা যে অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন মানুষের শ্রেণীচরিত্র বদলে দেয়। তাই কাঁসিরামের হাত ধরে যে যুব নেত্রী তাদের মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আর যে মায়াবতী গদিতে বসেই ব্যক্তিগত প্রচার এবং দুর্নীতির চোরা স্রোতে ডুব দিলেন দুজন মানুষ এক হলেও কখনওই আইডিওলজিতে এক থাকেনি।

এ-ই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। যে জননেত্রী বিরোধী থাকাকালীন কিছুটা হলেও মানুষের পাশে ছিলেন। সিপিএম সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতেন। ক্ষমতায় বসার মাত্র ১১ বছরের ভিতরেই তিনি সিপিএমের ৩৪ বছরের রেকর্ডকে বহু পেছনে ফেলে দিয়েছেন।


শ্রেণীচেতনার অভাবে রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের দেবতা বানিয়ে ফেলা সংক্রান্ত এই লেখা দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের ছাড়া তো সম্পূর্ণ হতেই পারে না। ফিল্মস্টার হোক বা রাজনৈতিক নেতা, তাদের দেবতা বানানোয় দক্ষিণ ভারতের বিশেষত তামিলনাড়ুর জনতার জুড়ি মেলা ভার। এম.জি. রামচন্দ্রন, করুনানিধি বা জয়ললিতা সিনেমার নায়ক-নায়িকারা রাজনীতিতে নামতেই চূড়ান্ত সাফল্য পেয়েছেন। সাধারণ জনতা যখন অভুক্ত থেকেছে জয়ললিতা তখন টাকার গদিতে আরাম করেছে। সাধারণ মানুষের থাকার জায়গা নাই থাকতে পারে কিন্তু জয়ললিতার দেশি-বিদেশি জুতোর জন্যও আলাদা ঘর ছিল বলে তার ভক্তরা গর্ব করে থাকে। এমনকি তার মৃত্যুর পরে ‘আম্মা’র শোকে অনেকে আত্মহত্যা করেছিল। 


দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জনতার চিনতে না পারার একটাই কারণ তা হল সঠিক শ্রেণীচেতনার অভাব। সঠিক চেতনা না গড়ে উঠলে তারা একই ভুল করতেই থাকবে। বর্তমানকালের উঠতি নেতা অভিষেক ব্যানার্জি, কানহাইয়াকুমার, কেজরিওয়াল হোক বা আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে ভোটে লড়া বারণ, তাদের ত্রুটিবিচ্যুতি বুঝতে হলে সঠিক রাজনৈতিক চেতনা গড়ে তুলতে হবে, তবেই নতুন ভার‍ত গড়ে উঠবে।


যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাসচর্চা -
মনীশ রায়চৌধুরী
Nov. 24, 2024 | রাজনীতি | views:809 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ইতিহাস! সেকি রবিবারের সকালে আবার ইতিহাস কেন? সে-তো স্কুলে অনেক পড়েছি। কত কষ্ট করে বাবর, হুমায়ুন, আকবর সব ফর্মুলা করে মনে রাখতাম। পানিপথের যুদ্ধ থেকে সিপাহী বিদ্রোহের সাল তারিখ সব মনে রেখে বড় বড় অক্ষরে খাতায় লিখতাম। বড় বড় অক্ষরে লিখলে বেশি পাতা লাগবে। যে যত এক্সট্রা পাতা নিত সে তত নম্বর পেত।


ইতিহাস বললেই আমাদের অধিকাংশ লোকের মনে এই ছবিটাই ভেসে ওঠে। কিন্তু প্রকৃত ইতিহাসচর্চা তো শুধুমাত্র রাজা-বাদশার যুদ্ধের সাল-তারিখ মনে রেখে নম্বর পাওয়া নয়, তার বিস্তৃতি অনেক ব্যাপক। ইতিহাস চর্চা সামগ্রিকভাবে করতে হলে বুঝতে হলে ভুগোল, বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব থেকে শুরু করে সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি সবকিছুই আলোচনা করতে হয়। 


ইতিহাসচর্চার সঠিক পদ্ধতি জানা বর্তমানে আরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছে কারণ বর্তমানে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন আরএসএস মতাদর্শপুষ্ট বিজেপি সরকার এই চর্চাকে গুলিয়ে দিতে চাইছে। ভারতীয় সংস্কৃতির স্বঘোষিত সেই ইজারাদারের দল স্বকপোলকল্পিত সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ণ এজেন্ডাকে ভারতের “চেপে রাখা প্রকৃত ইতিহাস” বলে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। তারা রাম, কৃষ্ণ, হনুমান প্রভৃতি পৌরাণিক চরিত্রদের ঐতিহাসিক বলে দাবি করছে। যেহেতু প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা থেকে মিডিয়া সবকিছুই তাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে তাই সেই অবাস্তব দাবি মান্যতা পেয়ে যাচ্ছে। বাবরি মসজিদ, রাম জন্মভূমি ইস্যুতে সুপ্রিম কোর্টের রায় তারই প্রমাণ। এই রায়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে এবার তারা মথুরাতে মসজিদের জমিতে কৃষ্ণের জন্মভূমি 'আবিষ্কার' করেছে। মোদ্দা কথা, এরা এমন এক ভারতের কথা প্রচার করে বেড়াচ্ছে যার প্রাচীনকালের আর্য ঋষিরা জ্ঞানবিজ্ঞানে আধুনিক প্রযুক্তির যুগের থেকেও শ্রেষ্ঠ ছিল এবং পরবর্তীকালে আগত মুসলিম শাসকদের হাতে পড়েই তাদের কল্পিত ভারতমাতার গরিমা নষ্ট হয়েছে। ভারতের যা কিছু সর্বনাশ হয়েছে সব কিছুর জন্য মুসলিম শাসকেরা দায়ী। তারাই নাকি হিন্দুদের গর্বের ঐতিহ্য নষ্ট করে দিয়েছে, মন্দির ভেঙে মসজিদ গড়েছে। এবং এই 'ভারতীয় সংস্কৃতির' পুনরুদ্ধার করে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ে তোলাই এদের একমাত্র লক্ষ্য।


কিন্তু যুক্তিবাদী দৃষ্টিতে ভারতের ইতিহাসের দিকে তাকালেই আমরা এক অন্য ভারতের সন্ধান পাব। আমরা দেখতে পাব ভারতের প্রাচীনযুগে আধ্যাত্মবাদী দর্শনের পাশাপাশি বস্তুবাদী দর্শনেরও প্রবল চর্চা ছিল। শুধুমাত্র চার্বাক নয়। ভূতবাদ, স্যাদবাদ, সাংখ্য, মীমাংসা, বৌদ্ধ, জৈন দর্শন ছিল। ভারতের প্রাচীনতম দর্শন মীমাংসা তো ঈশ্বরের অস্তিত্বের উপরেও গুরুতর প্রশ্নচিহ্ন তুলেছিল। প্রকৃত বৌদ্ধদর্শনে ঈশ্বর বা অলৌকিকতার কোন স্থান নেই। গৌতম বুদ্ধ বিনা প্রমাণে এমনকি তার কথাও মেনে নিতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পরেই ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রাসনের ফলে বৌদ্ধ ধম্ম (ধর্ম নয়) নিজের শুদ্ধতা অক্ষত রাখতে পারেনি। সম্ভবত ৭৮ খৃ:পূ:'তে কুন্দলবনে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বৌদ্ধসঙ্গীতিতে তারা হীনযান এবং মহাযানে বিভক্ত হয়ে যায়। হীনযানী বৌদ্ধরা তাদের মূলরূপ ধরে রাখে। কিন্তু বর্তমান ভারতে তাদের আর প্রায় কোন অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। মহাযানী বৌদ্ধরা বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলে প্রচার করে থাকে। সেখানে বৌদ্ধতন্ত্র থেকে জন্মান্তরবাদ নামক কুসংস্কার সম্পূর্ণভাবে বিদ্যমান।


বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং রাজতন্ত্রের মিলিত  আগ্রাসনের কারণ শুধু ধর্মীয় ছিল তা নয়। প্রাচীন ভারতে বেশ কিছু গণপ্রজাতন্ত্রী রাজ্য গড়ে উঠেছিল। যেখানে দলের লোকেরা ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করত এবং আধুনিক কালের মত নির্দিষ্ট সময় অন্তর সদস্যরা তা পরিবর্তন করতে পারত। বুদ্ধের জন্মের সময় তার বাবা শুদ্ধোদনও এমনই এক দলপতি ছিলেন। যেটাকে পরে হিন্দুত্ববাদীরা হিন্দু রাজা বলে প্রচার করে। 


স্বাভাবিক ভাবেই এমন গণরাজ্য রাজতন্ত্রের পক্ষে বিপদ। বুদ্ধের প্রভাবে এরকম গণরাজ্য বেড়েছিল। ফলে বৌদ্ধ চিন্তাচেতনাকে সমূলে উৎপাটন করা পুরোহিততন্ত্র এবং রাজতন্ত্র উভয়ের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। প্রকৃত সত্য এটাই প্রাচীন ভারত জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত ছিল বলে নব্য হিন্দুত্ববাদীরা যে গর্ব করে অর্থাৎ আর্যভট্ট, চরক, সুশ্রুত এদেরকে প্রাচীন ঋষিমুনি বলে দেখাতে চায় তা ভ্রান্ত। আসলে এই জ্ঞানতাপসেরা ছিলেন বৌদ্ধ শ্রমণ। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল বৌদ্ধ প্রভাবে গড়ে ওঠা শিক্ষাকেন্দ্র। 


আমরা কথায় কথায় বলে থাকি মুসলমান শাসকরা হিন্দুদের মন্দির ভেঙে দিয়ে মসজিদ গড়েছে, গণহত্যা করেছে, জবরদস্তি ধর্ম পরিবর্তন করেছে। কথাটা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা নয়। কিন্তু, যে কথা তারা চেপে যায় তা হল ব্রাহ্মণ্যবাদীরা রাজতন্ত্রের সাথে হাত মিলিয়ে বৌদ্ধ, জৈন, চার্বাকদের সাথে একই কাজ করেছে। মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণে তো এদের অসুর, রাক্ষস বলেও বর্ণনা করা হয়েছে। 


কলহন রচিত 'রাজতরঙ্গিনী' তে উল্লেখ আছে রাজা হর্ষদেব প্রায় ৪,০০০ বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করেছিলেন।  

পারমার বংশের সুভাতবর্মন থেকে চোল বংশের রাজারা, বাংলায় রাজা শশাঙ্ক সবাই বৌদ্ধ, জৈনদের ব্যাপক গণহত্যা করেছেন। স্বামী বিবেকানন্দের 'বাণী ও রচনা'র সপ্তম খন্ডে পাওয়া যায় পুরীর সুবিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরও আসলে বৌদ্ধ স্থাপত্য।


বর্তমানে সুচতুর ভাবে ইতিহাসের সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়েছে। পুরো ইতিহাসকেই আমাদের হিন্দু-মুসলিম ন্যারেটিভের মাধ্যমে দেখিয়ে সমাজে বিদ্বেষের বিষ ছড়ানো হচ্ছে। ফর্মুলা খুব সহজ, হিন্দু রাজারা ছিল দেশপ্রেমিক আর সুলতানী এবং মুঘল আমলের শাসকরা বিদেশী আক্রমণকারী। তাই রাণা প্রতাপ-আকবর, শিবাজি-ঔরঙ্গজেব প্রভৃতির পারস্পরিক ক্ষমতা দখলের লড়াইকেও প্রায় স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া হয়।


কিন্তু, ইতিহাস শুধুমাত্র তথ্যপ্রমাণকেই মান্যতা দেয়। মুসলিম শাসকেরা আসার পূর্বে তো ভারতে সবাই হিন্দু রাজা ছিল। তারা কিন্তু ধর্মের জন্য কেউ কাউকে ছেড়ে দিত না। তারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। সুলতানী আমলেও গোঁড়া মুসলিম শাসকের পাশাপাশি পরধর্মসহিষ্ণু বাদশাহদেরও উল্লেখ পাই। এমনকি পাগলা রাজা বলে ব্যঙ্গ করা মহম্মদ-বিন-তুঘলক তো কালীমূর্তি খোদাই করা মুদ্রাও চালু করেছিলেন। আবার ১২৯৬ সালে আলাউদ্দিন খিলজি তার কাকা জালালউদ্দিন খিলজির মাথা কেটে বর্শায় গেঁথে নিয়ে দিল্লির গদিতে বসেছিলেন। এখানেও কিন্তু ধর্ম নয় ক্ষমতার লোভই মূল কথা। তাই আমরা দেখতে পাই আকবরের প্রধান সেনাপতি ছিলেন রাজপুত রাণা মানসিং আবার রাণা প্রতাপের সেনাপতি ছিলেন হাকিম খাঁ। আকবরের অন্যতম অর্থমন্ত্রী হিন্দুরাজা  টোডরমল। নবরত্ন সভায় 'বীরবল' নামে ভূষিত ব্যক্তিও ছিলেন হিন্দু নাম মহেশ দাস। 


হিন্দুত্ববাদীরা সম্ভবত মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের উপর সবচেয়ে বেশি খড়গহস্ত। তিনি যে ধর্মীয় ভাবে অন্যান্য মুঘল শাসকদের তুলনায় গোঁড়া ছিলেন এমনকি কাশীতে মন্দির ভেঙেছিলেন তাও অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তা অর্ধসত্য মাত্র। সত্য এটাই আকবরের আমলে মুঘল সেনাবাহিনীতে হিন্দুসেনা ছিল প্রায় ২৪% যা ঔরঙ্গজেবের আমলে বেড়ে হয় ৩৩%। তার অন্যতম সেনাপতি ছিলেন রাজপুত জয়সিং। আমরা শুধু তিনি মন্দির ভেঙেছিলেন বলে দোষারোপ করি। কিন্তু তিনি মহাকাল মন্দির, মথুরার কৃষ্ণ মন্দিরে দান করেন। ১৬৮০ সালে বেনারসেই ভগবৎ গোঁসাইকে আশ্রম গড়তে, ১৬৮৫ তে কুমারস্বামী মঠ প্রতিষ্ঠা, ১৬৮৭ সালে রামজীবন গোঁসাইকেও আশ্রম করার জমি দেন। বস্তুত, হিন্দুবিদ্বেষী বলে প্রচার করা ঔরঙ্গজেব এত বেশি পরিমাণে হিন্দু মঠ, মন্দির, আশ্রম গড়তে সাহায্য করেছিলেন যে শুধু সেটাই আলাদা অধ্যায় হয়ে যেতে পারে। আরও মজার কথা তিনি কিন্তু মসজিদও ভেঙেছিলেন। কুতুবশাহীর শেষ নবাব গোলকুণ্ডার তানাশাহ তাকে খাজনা না দিয়ে জামিয়া মসজিদের তলায় সম্পত্তি লুকিয়ে রেখেছিল। ঔরঙ্গজেব চর মারফত খবর পেয়ে ১৬৮৩ সালে মসজিদ ভেঙে প্রাপ্য রাজস্ব আদায় করেন এবং তানাশাহ'কে বন্দী করেন। অর্থাৎ, রাজ্যশাসনের ক্ষেত্রে ধর্ম কখনোই তার কাছে মুখ্য ব্যাপার হত না।


কিন্তু, এসব সত্য বললে তো নব্য হিন্দুদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ হবেনা। তাই তারা শিবাজি-ঔরঙ্গজেব দ্বৈরথের ঘটনাকে হিন্দু মুসলিম ন্যারেটিভে প্রচার করে।

সেই মহাজ্ঞানীরা জানেওনা শিবাজির ১৩ জন মুসলিম সেনাপতি ছিলেন তাদের নাম সিদ্দি হিলাল, দৌলত খান, ইব্রাহিম খান, কাজি হায়দার, সিদ্দি ইব্রাহিম, সিদ্দি ওয়াহওয়াহ, নুর খান বেইগ, শমা খান, হুসেইন খান মিয়ানি, সিদ্দি মিস্ত্রি, সুলতান খান, দাউদ খান আর মাদারি মেহেতার।

ঔরঙ্গজেব যখন শিবাজিকে কৌশলে দুর্গে বন্দি করেন তখন মাদারি মেহেতার তার 'বডি ডামি' সেজে কেল্লায় বন্দী থেকে তাকে পালাতে সাহায্য করেন।

ক্রুদ্ধ ঔরঙ্গজেব শাস্তি হিসেবে মাদারির শিরচ্ছেদ করেন। 

পুনশ্চঃ, আফজল খানের সাথে শিবাজির যুদ্ধ এবং বাঘনখ দ্বারা তাকে হত্যা করার ঘটনা আমরা সবাই পড়েছি। কিন্তু, আমাদের এটা জানানো হয়না আফজলের সহকারী হিসাবে সেই তাঁবুতে শিবাজিকে হত্যা করার জন্য উপস্থিত অপর ব্যক্তির নাম ছিল কৃষ্ণ ভাস্কর কুলকার্নি। 


১৭৪১-১৭৫১ সালের ভিতর পাঁচবার রাঘোজি ভোঁসলে, ভাস্কর পন্ডিতের নেতৃত্বে মারাঠারা সুবা বাংলা আক্রমণ করে। তারা প্রায় চার লাখ মানুষকে হত্যা করে। ব্যাপক লুণ্ঠন, ধর্ষণ চালায়। তাদের অত্যাচারের তীব্রতা এতটাই বাঙালির মনে দাগ কেটেছিল যে "বর্গী এলে দেশে" শিশুদের লোককথায় স্থান পায়। পরাজিত নবাব আলিবর্দি খাঁ ১৭৫১ সালে মারাঠাদের সাথে বার্ষিক ১.২ মিলিয়ন অর্থ চৌথ এবং ৩.২ মিলিয়ন অর্থ বিগত দশ বছরের যুদ্ধখরচ দিয়ে মারাঠাদের সাথে চুক্তি করেন যে তারা আর বাংলা আক্রমণ করবেনা। বাঙালি কবি গঙ্গারাম মারাঠাদের অসুরের সাথে তুলনা করে 'মহারাষ্ট্রপুরাণ' রচনা করেন এবং দেবী দুর্গার কাছে প্রার্থনা করেন তিনি যে বাংলাকে বর্গী হানা থেকে রক্ষা করার জন্য নবাব আলিবর্দিকে আশীর্বাদ করেন।  


১৭৯১ সালে মারাঠাদের হিন্দু নির্যাতনের আরও একটা উদাহরণ পাওয়া যায়। তারা শ্রীরঙ্গপত্তমের যুদ্ধে টিপু সুলতানকে পরাজিত না করতে পারার হতাশায় শৃঙ্গেরি শঙ্করাচার্যের মঠ ভেঙে দেয় এবং হত্যাকাণ্ড চালায়। মঠাধ্যক্ষ টিপুকে এই ঘটনা জানালে তিনি তৎক্ষনাৎ 'আসাফ অফ বেদনুর'কে ত্রাণকার্যে ২০০ 'রাহতি' পাঠানোর নির্দেশ দেন।


ইতিহাস ঘাঁটলেই এমন অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যেতে পারে যেখানে হিন্দু রাজা হিন্দু রাজার সাথে,  মুসলিম শাসকেরা মুসলিমদের সাথেই লড়াই করে মরেছে। তাদের ধর্মীয় পরিচয় কিন্তু মুখ্য হয়ে ওঠেনি। তাদের ক্ষমতা দখলের শাসন করার, শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার ইচ্ছাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাই ইতিহাস পড়ার সময় ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের চশমা খুলে ফেলা উচিত। 

এত দীর্ঘ প্রবন্ধের অবতারণা করার একটাই কারণ। বর্তমান শাসকগোষ্ঠী নিজেদের কর্পোরেট লবির স্বার্থরক্ষায় দরিদ্র বঞ্চিত ভারতবাসীকে এক হতে দিতে চায়না। তারা চায় জাতি, ভাষা, ধর্মের নামে নিপীড়িতরা নিজেদের ভিতরেই লড়াই করুক। তাই হাজার দু'হাজার বছর আগে কোন ধর্মের শাসক কার উপর অত্যাচার করেছে সেই ইতিহাস তুলে এনে আজ বিকৃত মানসিকতায় ধর্মীয় বিদ্বেষের চর্চা করবেন না, করলে নিজেরাই ইতিহাস হয়ে যাবেন।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86930